• নরসিংদী
  • মঙ্গলবার, ১৬ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ; ০১ জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

Advertise your products here

Advertise your products here

নরসিংদী  মঙ্গলবার, ১৬ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ;   ০১ জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
website logo

স্বাধীনতার ৫১ বছরেও নরসিংদীতে অরক্ষিত বধ‍্যভূমিগুলো


জাগো নরসিংদী 24 ; প্রকাশিত: রবিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ, ০৬:৫৩ পিএম
স্বাধীনতার ৫১ বছরেও নরসিংদীতে অরক্ষিত বধ‍্যভূমিগুলো
অরক্ষিত বধ‍্যভূমি

মো.শাহাদাৎ হোসেন রাজু: ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞের কথা মনে হলে এখনও আঁতকে ওঠে নরসিংদীবাসী। জেলাজুড়ে স্বাক্ষী হয়ে রয়েছে অনেকগুলো বধ্যভূমি। স্বাধীনতার ৫১ বছর পার হলেও আজো অরক্ষিত রয়েছে জেলার বেশ কয়েকটি  বধ্যভূমি।  অযত্ন আর অবহেলায় মুছে যাচ্ছে বধ্যভূমিগুলোর শেষ চিহ্নটুকু।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাক হানাদার বাহিনী রাজাকারদের সহযোগিতায় নরসিংদী জেলার ১৫টি বধ্যভূমিকে বিভক্ত করে নৃশংস হত্যাকান্ড চালিয়ে ছিল।

স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫১ বছর পাড় হলেও আজো জেলার বেশ কয়েকটি বধ্যভূমি চিহ্নিত না করায় অযত্নে আর অবহেলায় অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। আবার অনেকগুলোর শেষ স্মৃতিচিহ্ন পর্যন্ত মুছে ফেলা হয়েছে। দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান আর তার পরিবারের উন্নতি হলেও উন্নত হয়নি ৭১’ হায়েনাদের হাতে নিহত বীর সেনাদের স্মৃতিচিহ্নগুলো।

জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সূত্রে জানা যায়, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নরসিংদী সদর উপজেলার পাঁচদোনা ব্রিজ সংলগ্ন এলাকা, শীলমান্দী মাছিমপুর বিল, খাটেহারা ব্রিজ, ডাঙ্গা বাজারের পাশে শীতলক্ষ‍্যা নদীর পাড়, পূবালী জুটমিলের পাশে আটিয়াগাঁও, গয়েশপুর পদ্মলোচন উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠ, শিবপুরের ঘাসিরদিয়া, বেলাব উপজেলার আড়িয়াল খাঁ নদীর পাশে বড়িবাড়ি, রায়পুরার মেথিকান্দা রেল স্টেশনের পার্শ্ববতী স্থান ও মনোহরদী উপজেলার পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ উল্লেখযোগ‍্য।

এই স্থানগুলোতে মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ এলাকাবাসীকে ধরে এনে নির্বিচারে হত্যা করে লাশ ফেলে রাখত পাকিস্তানি সেনারা।  

এলাকাবাসী ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্যোগে চিহ্নিত জেলার ৩টি বধ্যভূমিতে ইতোমধ‍্যে সরকারী খরচে নির্মাণ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ, মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামফলক তাদের কবর। চিহ্নিত সেই ৩টি বধ‍্যভূমি  হলো, নরসিংদী সদরের পাঁচদোনা লোহারপুল, বেলাবর বড়িবাড়ি ও রায়পুরার মেথিকান্দা।

এসব বধ্যভূমির মধ্যে পাঁচদোনা বধ্যভূমি এলাকায় নির্মাণ করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন। বড়িবাড়িতে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে একটি স্মৃতিসৌধ।  রায়পুরার মেথিকান্দার বধ্যভূমিতে চারজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধাকে সনাক্ত করে তাদের নামফলকসহ আলাদা আলাদা চারটি কবর নির্মাণ করা হয়েছে। 

বেলাব বড়িবাড়ি বধ্যভূমি

১৪ জুলাই দিনটিতে বেলাব'র বড়িবাড়ি এলাকায় নেমে আসে শোকের ছায়া। প্রত্যক্ষদর্শী এলাকাবাসী, নিহতদের স্বজন ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে সেই ভয়ানক দৃশ্য। আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তারা, সেদিন ৫ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ বেলাব ও তার পাশ্ববর্তী এলাকার ৬৮ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে নির্বিচারে হত্যা করেছিল পাকবাহিনী।

পিতার সামনে সন্তান, সন্তানের সামনে পিতা, মেয়ের সামনে মাকে, ভাইয়ের সামনে বোনকে, স্ত্রীর সামনে স্বামীকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিলো পাক সেনারা। নিরীহ গ্রামবাসীকে হাত-পা ও চোখ বেঁধে হত্যা করে তাদের লাশ ফেলে দেওয়া হয়েছিল আড়িয়াল খাঁ নদীতে।

এরকম অনেক লাশ নদী থেকে উঠিয়ে আড়িয়াল খাঁ নদীর তীরে বড়িবাড়িতে একসাথে মাটিচাপা দেওয়া হয়। পরবর্তী ওই স্থানটিকে চিহ্নিত করে স্মরণীয় করে রাখতে এখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। তবে অযত্ন আর অবহেলায় স্মৃতিসৌধটির এখন বেহাল দশা। গরু, ছাগল, কুকুর, বিড়ালসহ বিভিন্ন প্রাণীর অবাধ বিচরণ দেখা যায় স্মৃতিসৌধ বেদীতে। ইতোমধ‍্যে ভেঙে গেছে স্মৃতিসৌধের অনেকাংশ।

এই এলাকার যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী এবং বীরের বেশে যুদ্ধে শহীদ হওয়া সুবেদার আবুল বাশারের লাশটি এলাকাবাসীর উদ্যোগে সমাহিত করা হলেও সেই সমাধিটিও ঝোঁপ ঝাড়ের মধ্যে অযত্নেপড়ে আছে। এলাকাবাসী ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা একাধিকবার এ স্থানটি সরকারীভাবে সংরক্ষণের দাবি জানালেও কোন ফল হয়নি।

নরসিংদীর পাঁচদোনা লোহারপুল বধ্যভূমি

নরসিংদীর সদর উপজেলার একমাত্র বধ্যভূমি পাঁচদোনার লোহারপুল। মুক্তিযুদ্ধের সময় জেলা সদরের বিভিন্ন এলাকা থেকে ২৭ থেকে ২৮ জনকে ধরে নিয়ে পাকিস্তান সেনাদের ক্যাম্প নরসিংদীর টেলিফোন এক্সচেঞ্জে আটকে রাখা হয়।

নির্যাতন শেষে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় বর্তমান ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাঁচদোনা মোড় সংলগ্ন লোহারপুলের নিচে। সেখানে ৪ থেকে ৫ জনকে বসিয়ে রেখে তাদের সামনে ২০ থেকে ২২ জনকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা।

হত্যার পর সেখানেই মাটিচাপা দেওয়া হয় তাদের। এই স্থানটিকে স্মরণীয় করে রাখতে বর্তমানে নির্মাণ করা হয়েছে একটি মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন ও একটি স্মৃতিসৌধ। ইতোমধ‍্যে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবনের নির্মাণ কাজ শেষ হলেও চলমান রয়েছে স্মৃতিসৌধের নির্মাণ কাজ।

রায়পুরার মেথিকান্দা গণকবর

রায়পুরার মেথিকান্দা রেল স্টেশনের সংলগ্ন রেল লাইনের পাশের স্থানটিতে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাহিনী নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিলো। পার্শ্ববর্তী বর্তমান উপজেলা পরিষদের টর্চার সেলে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয় পাঁচ মুক্তিযোদ্ধাসহ প্রায় ৩০ জন নিরীহ মানুষকে। তাদের ওই স্থানেই মাটিচাপা দেওয়া হয়। প্রতি বছর এখানে শহীদদের স্মরণে জড়ো হন মুক্তিযোদ্ধারা। 

সম্প্রতি এই বধ‍্যভূমিতে চারজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধাকে সনাক্ত করে তাদের নামফলকসহ আলাদা আলাদা চারটি কবর নির্মাণ করা হয়েছে। সনাক্ত হওয়া ওই চারজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হলেন- শহীদ হাফিজ মিয়া, শহীদ আহসান উল্লাহ, শহীদ সেকান্দার আলী সিকদার ও শহীদ আবু নঈম মো. নাজিম উদ্দিন। তবে এখনও সেখানে নির্মাণ করা হয়নি কোনও স্মৃতিস্তম্ভ। বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান, সেক্টর কমান্ডার বীর উত্তম নূরুজ্জামান, বীর বিক্রম খন্দকার মতিউর, বীর বিক্রম শাহাবুদ্দিন ও বীর প্রতিক মোবারক হোসেন এই পাঁচজন রাষ্ট্রীয় খেতাব প্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার জন্মভূমি এই রায়পুরা।

এদিকে মনোহরদী বধ্যভূমিকে সরকারী বা বেসরকারী উদ‍্যোগে চিহ্নিত না করায় সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে স্থানীয় একটি বিদ‍্যালয়ের টয়লেট। যা সত‍্যই নিন্দনীয় ও দু:খজনক।

মনোহরদী বধ্যভূমি

মনোহরদী উপজেলার পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় ছিল ১৯৭১ সালে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প। পাকিস্তানি বাহিনী নিরীহ শত শত মানুষকে ধরে এনে নির্যাতনের পর হত্যা করতো পাশেই ব্র‏হ্ম‏পুত্র নদী তীরের বর্তমানে বিদ্যালয় সংলগ্ন স্থানে।

লাশগুলো ফেলা হতো ব্র‏হ্মপুত্র নদীতে কিংবা নদীর তীরে মাটিচাপা দেওয়া হতো। অত‍্যন্ত পরিতাপের বিষয় স্বাধীনতার ৫১ বছরেও ওই স্থানটি সরকারিভাবে চিহ্নিত করে নির্মাণ করা হয়নি কোনো স্মৃতিসৌধ। বরং দুঃখজনক হলেও সত্য যে বধ্যভূমির সেই জায়গাটিতে তৈরি করা হয়েছে ওই বিদ‍্যালয়ের টয়লেট।

জিনারদী বধ‍্যভূমি

জিনারদী ইউনিয়নের গয়েশপুর পদ্মলোচন উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে পাক-হানাদার বাহিনী এ এলাকার আশ-পাশের গ্রাম থেকে শতাধিক সাধারণ মানুষকে ধরে এনে মাঠে দাঁড় করায়।

পরে লাইন থেকে এক এক করে সাতজনকে গুলি করে হত্যা করে এখানেই মাটি চাপা দেয়। গয়েশপুর পদ্মলোচন উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠের উত্তর পূর্ব কোণে শহীদ মিনারের পেছনে অবস্থিত ওই বধ্যভূমিতে শহীদদের স্মরণে চারকোণা একটি স্তম্ভ তৈরি করা হলেও তা কারো নজরেই পড়ে না।

পলাশের ডাঙ্গা বাজারের পাশে নদীর পাড়ে ২২ জন, ঘোড়াশালের পূবালী জুটমিলের পাশে আটিয়াগাঁও গ্রামে ১২ জনকে একসাথে গুলি করে হত্যা করে পাক হানাদার বাহিনী। কিন্তু এই স্থান দুটি আজো সরকারিভাবে চিহ্নিত করা হয়নি।

৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস নরসিংদী জেলার বিভিন্ন স্থানে শতাধিক খণ্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। ওই খণ্ড যুদ্ধে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর নির্মমতার শিকার হয়ে শহীদ হন ১১৬ জন বীর সন্তান।

এর মধ্যে ছিলেন নরসিংদী সদরের ২৭, মনোহরদীর ১২, পলাশে ১১, শিবপুরের ১৩,রায়পুরায় ৩৭ ও বেলাব উপজেলার ১৬ জন। এছাড়া বহু মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে নরসিংদী হানাদার মুক্ত হয়।

মুক্তিযুদ্ধের সেই নির্মম মৃত্যুর আর্তচিৎকার আজও শুনতে পায় নরসিংদীবাসী। আজও পীড়া দেয় সেই ভয়াল স্মৃতিগুলো।  যুদ্ধকালীন সময়ে জেলার যে স্থানগুলোতে চালানো হয়েছিল নির্মম হত‍্যাযজ্ঞ সেগুলোর মধ‍্যে এখনও পর্যন্ত যেসব স্থানগুলোতে  সরকারী বে-সরকারী কোন উদ্যোগে গ্রহণ করা হয়নি।

সেই সকল বধ‍্যভূমি ও গণকবরে শায়িত শহীদদের স্মৃতি রক্ষায় এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরতে  সেগুলোকে চিহ্নিত করে স্মৃতি ফলক নির্মাণ এখন সময়ের দাবি।

তাই নরসিংদীবাসী ও নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধে নরসিংদীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান সম্পর্কে জানতে অবিলম্বে বধ্যভূমিগুলো চিহ্নিত করে স্মৃতি ফলক নির্মাণ ও নামকরণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট জোর দাবি জানান মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ পরিবারগুলো।

 

 

 

বিশেষ সংবাদ বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ