
মো. শাহাদাৎ হোসেন রাজু: নরসিংদীর বেলাব উপজেলার চন্দনপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. বজলুর রহমান ভূঁইয়া (মজনু) একজন জীবন্ত মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ করেন এবং মুজিব বাহিনী বা বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ)-এর সক্রিয় সদস্য হিসেবে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ফ্রন্টে দায়িত্ব পালন করেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাষ্ট্রীয় নির্দেশনা অনুযায়ী তিনি যুদ্ধকালীন সময়ে ব্যবহৃত অস্ত্র সরকারকে জমা দেন। যুদ্ধ শেষে তাঁর নামে মুক্তিযুদ্ধকালীন 'পূর্ণ মুক্তিযোদ্ধা' সনদ, উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের প্রত্যয়নপত্র, এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সম্বলিত ডিজিটাল মুক্তিযোদ্ধা কার্ড প্রদান করা হয়।
এছাড়াও তাঁর সংগ্রহে রয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম.এ.জি ওসমানীর প্রত্যয়নপত্র, যেখানে উনাকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। উনার নাম ডিজিটাল মুক্তিযোদ্ধা কার্ডে রয়েছে ফাইল নং: ডিজিবি১৯০১৭৭ হিসেবে।
এতসব অকাট্য প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও স্বাধীনতা পরবর্তী গত ৫৪ বছরেও তার গেজেট ভুক্ত হয়নি। তিনি রাষ্ট্রীয়ভাবে পাননি মুক্তিযোদ্ধা সনদ। তাই দেশের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁর নাম এখনো পর্যন্ত তালিকায় আনুষ্ঠানিকভাবে অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় তিনি পাননি মুক্তিযুদ্ধা স্বীকৃতি। ফলে বঞ্চিত থেকেছেন সরকারের পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধাদের দেওয়া নির্ধারিত সুযোগ-সুবিধা।
এ ব্যাপারে মুক্তিযোদ্ধা বজলুর রহমানের স্বজনরাসহ এলাকাবাসী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'যিনি নিজের জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন, সেই বীর আজ বছরের পর বছর সনদের জন্য ছোটাছুটি করছেন। অথচ অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা দিব্যি সরকারি সুবিধা ভোগ করছেন।”
বজলুর রহমান ভূঁইয়া জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি বেলাব পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। স্কুল জীবনে থেকেই তিনি ছাত্র আন্দোলনের সক্রিয় সদস্য ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব মুহূর্তে বারিক কমান্ডার নামে একজনের বাসায় থাকতেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তৎকালীন বেলাব উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শমসের আলী ভূঁইয়ার নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে (তারিখ ওই মুহূর্তে মনে করতে পারেননি তিনি) নৌকা যোগে ভারতে চলে যান বজলুর রহমান ভূঁইয়া। সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশে ফিরে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে তিনি ১১ নং সেক্টরে সেক্টর কমান্ডার তাজুদ্দিন এবং সহকারী কমান্ডার হিসেবে বেলাব উপজেলার হাড়িসাংগান গ্রামের সেলিম মোল্লার অধিনে কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় তিনি যুদ্ধে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তিনি কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর এলাকায় একটি সম্মুখ সমরে তিনি অংশ নিয়ে ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মুক্তিযোদ্ধা সনদ লাভে বিভিন্ন দপ্তরে দৌড় ঝাপ শুরু করেন তিনি। কিন্ত সবশেষ নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য রাষ্ট্রের এই শ্রেষ্ট সন্তানের কাছে ৪০ হাজার টাকা উৎকোচ দাবী করলেই বাদ সাধেন তিনি। তিনি সেই টাকা না দিয়ে নিরাশ হয়ে দৌড়ঝাপ বন্ধ করে দেন। এরপর থেকে তিনি অনেকটা রাগে ক্ষোভে তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য আর কোথাও কোন কাগজপত্র জমা দেননি।
বজলুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, 'আমি দেশকে ভালোবেসে যুদ্ধ করেছি। কোনো কিছু পাওয়ার জন্য নয়। বেশ কয়েকবার আবেদন করেছি। কাগজপত্র জমা দিয়েছি। শেষমেষ তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আমার কাছ থেকে ৪০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেছিল। সেটাও আজ থেকে ২০ বছর আগে। এই ৪০ হাজার টাকা ঘুষ আমি দিবো না। তাই এরপর থেকে আবেদন করা ছেড়ে দিয়েছি। এ নিয়ে আর যেন দৌড় ঝাপ না করি ছেলেরাও আমাকে তেমনটাই বলেছে।
আমি জানিনা আপনারা আমার বিষয়ে কি জেনেছেন, কতটুকু জেনেছেন, কিভাবে খোঁজ পেলেন আমার। আপনাদের লিখনিতে যদি আমার বিষয়টি সরকারের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে আসলে শুধু এতটুকুই বলবো, আমার জীবন তো এভাবেই কেটে গেল। তবে আমার মত অন্য কোন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যেন বঞ্চিত না হয় সরকারের কাছে আমার সেটাই দাবি থাকবে।
মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় আমার নাম উঠানোর জন্য আর কারো দারস্ত হবো না।
স্থানীযরা জানান,, জাতির প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে আমরা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরসমূহকে বলছি—এই বীর মুক্তিযোদ্ধার আবেদনটি যেন দ্রুত বিবেচনায় নিয়ে তাঁকে তাঁর ন্যায্য প্রাপ্য স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। এই মানুষটি রাষ্ট্রীয় সনদ পাওয়ার যে লড়াই লড়ছেন, সেটি যেন স্বাধীন দেশের মাটিতে আর দীর্ঘ না হয়।'