মো.শাহাদাৎ হোসেন রাজু: নরসিংদীতে জমে উঠেছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। জেলার ৫টি সংসদীয় আসনে এবার নির্বাচনী মাঠে লড়াই হবে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী এ দুটি দলের প্রার্থীদের মধ্যে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
এছাড়াও মাঠে রয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ, এনসিপিসহ অন্য দলের প্রার্থীরা। তরুণ ভোটারদের সক্রিয় উপস্থিতি এ নির্বাচনে বাড়িয়েছে অতিরিক্ত মাত্রা। ইতোমধ্যে এনসিপিও আসনগুলোতে তাদের প্রার্থীতা ঘোষণা করেছে।
বৃহস্পতিবার (১১ ডিসেম্বর) নির্বাচনী তফসিল ঘোষনা করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন। তফসিল অনুযায়ী আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি ভোট।
জেলার আসনগুলোর মধ্যে নরসিংদী-৩ (শিবপুর) আসনটি বাদে বাকি চারটি আসনে বিএনপি মনোনীত ধানের শীষের প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। জামায়াতও তাদের প্রার্থীদের বিজয়ী করতে সর্বশক্তি নিয়ে তৎপরতা শুরু করেছে।
তবে বিগত নির্বাচনগুলোতে জামায়াত নরসিংদীর কোন আসন থেকেই জয়লাভ করতে পারেনি। তাছাড়া এনসিপি, এলডিপি, গণঅধিকার, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিশসহ অন্য দলের প্রার্থীরাও বেশির ভাগ আসনেই তৎপরতা চালাচ্ছেন।
নরসিংদী-১ (সদর): এ আসনে স্বাধীনতার পর থেকে পালাক্রমে আওয়ামী লীগ জাতীয় ও বিএনপি তাদের তাদের দখলে নিলেও। এবার মাঠে নেই নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ। জাতীয় পার্টিরও (জাপা) তেমন কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। ফলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে মূলত বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থীর মধ্যে।
এ আসনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন দলের যুগ্ম মহাসচিব ও জেলা বিএনপির সভাপতি, সাবেক এমপি খায়রুল কবির খোকন। তার সাথে রয়েছে তৃণমূলের বিশাল কর্মী বাহিনী। তাছাড়া সাবেক এমপি হওয়ার সুবাদে এবং দীর্ঘদিন ধরে মাঠের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত থাকায় এলাকায রয়েছে ব্যাপক পরিচিতি।
জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে এ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন জেলার মজলিশে সূরা ও কর্মপরিষদ সদস্য মো. ইব্রাহিম ভূঁইয়া। দীর্ঘদিন ইসলামী ব্যাংকে হিন্দি ও মাধবদী শাখায় চাকুরির সুবাদে তারও রয়েছে ব্যাপক পরিচিতি। সম্প্রতিক কিছু উঠান বৈঠকে তার বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে এলাকায় বিতর্কের মুখে পড়েন তিনি। এ আসনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মাওলানা শওকত হোসাইন সরকার। জামায়াত ইসলামি বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ইসলামী আন্দোলন দেশের সাথে জোট বদ্ধ হয়েছেন। জোটবদ্ধ হওয়ার পর এ আসনের কারণ মানুষ এই জোটের প্রার্থী কে হবেন ইব্রাহিম ভূঁইয়া নাকি মাওলানা শওকত হোসাইন সরকার সেদিকে দিকেই চোখ। মূলত ধানের শীষের প্রার্থীর সাথে লড়াই হবে করা আমায়াতে ইসলামীর করা ৮ দলীয় জোটের প্রার্থীর।
এছাড়াও নরসিংদী-১ আসনে এনসিপির আবদুল্লাহ আল ফয়সাল, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মাহমুদুল হক ভূঁইয়া, খেলাফত মজলিশের মহিউদ্দিন জামিল।এ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করবেন জন্য ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন অ্যাড. সারোয়ার হোসেন খান। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ভোট যুদ্ধে লড়বেন।
১৯৮৬ সালের নির্বাচনে এ আসন থেকে জাতীয় পার্টির প্রয়াত মেজর সামসুল হুদা বাচ্চু, ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টির মোস্তফা জামাল বেবি, ১৯৯১, ১৯৯৬-এর ফেব্রুয়ারি ও ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে বিএনপি থেকে সামসুদ্দীন আহমেদ এছাক এমপি নির্বাচিত হন।
২০০৫-এর উপনির্বাচনে খায়রুল কবির খোকন বিএনপি প্রার্থী হিসেবে এমপি নির্বাচিত হন। এরপর এ আসনটি আওয়ামী লীগের দখলে চলে যায়। ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮, এবং ২০২৪-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে লে. কর্নেল (অব) মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম হিরু (বীর প্রতীক) এ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন।
নরসিংদী-২ (পলাশ): জেলার পলাশ উপজেলা ও সদরের পাঁচদোনা মেহেরপাড়া ও আমদিয়া এই তিনটি ইউনিয়ন নিয়ে নরসিংদী-২ সংসদীয আসন থেকে আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, সাবেক মন্ত্রী ড. আব্দুল মঈন খান। দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ হিসেবে তার ব্যাপক গ্রহনযোগ্যতা রয়েছে। ক্লিন ইমেজের অধিকারি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়ে বিএনপি সরকারে আসলে তিনি গুরুত্বপূর্ণ কোন পদে আসীন থাকবেন এমন কথা বর্তমানে তার এলাকায় চর্চা হচ্ছে বলে স্থানীয়রা জানায়।
এ আসনে জামায়াতে ইসলামীর দাড়িপাল্লা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনী মাঠে লড়বেন জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি উপাধ্যক্ষ মো. আমজাদ হোসেন। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ইঞ্জিনিয়ার মহসিন আহমেদ, খেলাফত মজলিশের মুফতি ফারুখ হোসেন।
১৯৮৬ সালের নির্বাচনে এ আসনে ন্যাপের প্রার্থী হিসেবে দৈনিক সংবাদের প্রধান সম্পাদক, প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ প্রয়াত আহমেদুল কবির মনু মিয়া এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টির মো. দেলোয়ার হোসেন খান এ আসনে এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৯১, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬, ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান এ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন।
পরবর্তীতে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ডাক্তার আনোয়ারুল আশরাফ খান দিলীপ এ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালে দিলীপের ছোটভাই আওয়ামী লীগ নেতা কামরুল আশরাফ খান পোটন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে এমপি নির্বাচিত হন। ২০১৮ ও ২০২৪ সালে পুনরায় আনোয়ারুল আশরাফ খান দিলীপ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে এ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন।
নরসিংদী-৩ (শিবপুর): এ আসনে কৌশলগত কারণে বিএনপি এখনো কোন প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেনি। তবে এ আসনে বিএনপির শরীকদল গণফোরামের প্রার্থী অ্যাড. জগলুল হায়দার আফ্রিকের নামও শোনা যাচ্ছে। শিবপুর আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীর তালিকায় রয়েছেন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুর এলাহী, জেলা বিএনপির সহসভাপতি তোফাজ্জল হোসেন মাস্টার, উপজেলা বিএনপির সভাপতি আবুল হারিছ রিকাবদার কালামিয়া ও ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাবেক সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান মিন্টু।
তবে বিএনপির সাবেক মহাসচিব ও সাবেক এলজিআরডি মন্ত্রী প্রয়াত আব্দুল মান্নান ভূঁইয়ার স্মৃতি ধরে রাখতে সংগঠন আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া স্মৃতি পরিষদের আহ্বায়ক, শিবপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আরিফ-উল-ইসলাম মৃধা এ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে জানা গেছে। এ আসনে জামায়াতের ইসলামীর প্রার্থী হয়ে ভোটে লড়বেন মোস্তাফিজুর রহমান কাউছার।
এ আসনটিতে ১৯৮৬ সালে ১৪ দলীয় জোটের কামাল হায়দার, ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টি থেকে শাজাহান সাজু সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। একসময় বিএনপির দুর্গ হিসেবে পরিচিত এ আসনে ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এবং পরবর্তীতে পুনরায় ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে ধানের শীষ প্রতীকে বিএনপির সাবেক মহাসচিব ও সাবেক মন্ত্রী আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া এমপি নির্বাচিত হন।
২০০৮ সালে সংস্কারপন্থী হিসেবে বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হলে আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া ধানের শীষের পরিবর্তে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে হাঁস প্রতীকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জহিরুল হক ভূঁইয়া মোহনের কাছে পরাজিত হন। এরপর থেকে আসনটি বিএনপির হাতছাড়া হয়। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ বিদ্রোহী সিরাজুল ইসলাম মোল্লা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জহিরুল হক ভূঁইয়া মোহনকে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালেও জহিরুল হক ভূঁইয়া মোহন আওয়ামী লীগের টিকিটে পুনরায় এমপি নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ২০২৪ সালে আবারো সিরাজুল ইসলাম মোল্লা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মোহনকে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হন।
নরসিংদী-৪ (মনোহরদী-বেলাব): জেলার মনোহরদী ও বেলাব এ দুটি উপজেলা নিয়ে নরসিংদী-৪ সংসদীয আসন। এ আসন থেকে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন সাবেক এমপি সরদার সাখাওয়াত হোসেন বকুল। এখানে জামায়াতে ইসলামীর মো. জাহাঙ্গীর আলম।
এর আগে ১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগের প্রয়াত অ্যাড. নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টির মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ ভূঁইয়া এবং উপ-নির্বাচনে জাতীয় পার্টির এ এইচ এম আব্দুল হালিম এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালে বিএনপির সরদার সাখাওয়াত হোসেন বকুল এবং ১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনেও তিনি নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিটে সাবেক সেনা প্রধান নুরউদ্দীন খান এমপি নির্বাচিত হন।
২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির সরদার সাখাওয়াত হোসেন বকুল এমপি নির্বাচিত হন। এরপর থেকে ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের টিকিটে প্রয়াত নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন এমপি নির্বাচিত হন।
নরসিংদী-৫ (রায়পুরা): এ আসন থেকে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সহসম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মো. আশরাফ উদ্দিন বকুল। জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী হচ্ছেন জাহাঙ্গীর আলম, ইসলামী আন্দোলনের মো. বদরুজ্জামান।
এ আসনে ১৯৮৬ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগ নেতা আসাদুল হক খসরু, ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টির মাঈন উদ্দিন ভূঁইয়া, ১৯৯১ সালে বিএনপির আবদুল আলী মৃধা এবং ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে আবদুল আলী মৃধা এমপি নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু এমপি নির্বাচিত হন। পরে একাধারে ২০০১, ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে সংসদ নির্বাচনে রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু আওয়ামী লীগের টিকিটে এমপি নির্বাচিত হন।
২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নবম সংসদ নির্বাচনে নরসিংদীর পাঁচটি আসনের সবকয়টিতেই জয় পায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। এর আগে ১৯৯১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে নরসিংদীর পাঁচটি আসনেই বিএনপির প্রার্থীরা জয়লাভ করেন।