• নরসিংদী
  • বৃহস্পতিবার, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ; ০২ মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

Advertise your products here

Advertise your products here

নরসিংদী  বৃহস্পতিবার, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ;   ০২ মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
website logo

হানাদার বাহিনীর টর্চার সেল ছিলো নরসিংদী টিএন্ডটি ভবন


জাগো নরসিংদী 24 ; প্রকাশিত: বুধবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ, ০৫:৪৭ পিএম
হানাদার বাহিনীর টর্চার সেল ছিলো নরসিংদী টিএন্ডটি ভবন
টিএন্ডটি ভবন। ছবি : জাগো নরসিংদী

মো.শাহাদাৎ হোসেন রাজু: ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নরসিংদী শহরের টেলিফোন এক্সচেঞ্জ (টিএন্ডটি) ভবনের স্টাফ কোয়াটারের ঘরগুলো । যেখানে ছিল পাক বাহিনীর টর্চার সেল।

সেই ঘরগুলোতে পাকিস্তানি সেনাদের অমানুষিক নির্যাতনে আর্তনাদ আর চিৎকার করেছে অসংখ্য নিরীহ বাঙালি। সেদিনের সেই আর্তনাদ  আজো অনেকের কানে ভেসে আসে।  আজো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সেই টর্চার সেল।

আর পাঁচদোনা সেতু সংগ্লগ্ন স্থানটি যা স্মরণ করিয়ে দেয় মুক্তিযুদ্ধের সেই রোমহর্ষক ঘটনার।

দীর্ঘদিন অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত নরসিংদী টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবনের হানাদার বাহিনীর টর্চার সেলের সেই ঘরগুলো।

কোনটির টিন সরে গেছে, কোনটির দরজা জানালা কিছুই নেই, অনেকগুলোর ইট শুরকি খসে অনেক আগ থেকেই ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে আছে।  সংরক্ষণের নেই কোন উদ্যোগ।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিকামী বাঙালিদের ওপর গণহত্যা শুরু করে। তবে নরসিংদীতে পাকিস্তানি বাহিনী প্রবেশ করে ১০ এপ্রিল রাতে।

নরসিংদী প্রবেশ করে শহরের টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবনে প্রধান ঘাঁটি স্থাপন করে পাকিস্তানি বাহিনী। পরে সেখানে স্থানীয় টাউট, দালাল ও রাজাকারদের যোগসাজসে হানাদার বাহিনীরা প্রতিদিন চালায় ধর্ষণ, নরহত্যা ও লুটতরাজ।

ইতিপূর্বে ৩ এপ্রিল আকাশ বাণীতে প্রচার করা হয় যে, নরসিংদী থেকে প্রায় চার হাজার বাঙালি সৈন্য ও মুক্তিযোদ্ধা ঢাকা আক্রমণের জন্য রওনা হয়েছেন।

এ খবর প্রচারিত হওয়ার পর পরই পাকিস্তানি বাহিনী ৪ ও ৫ এপ্রিল বিমান থেকে ১ ঘণ্টাব্যাপী নরসিংদী শহরে বোমাবর্ষণ করে। এতে শহরের বাড়িঘর ও দোকানপাট পুড়ে গিয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।  বিমান বাহিনীর বোমা বর্ষণে শহীদ হন আবদুল হক ও নারায়ণ চন্দ্র সাহাসহ নাম না জানা আরো আট জন।

১৯৭১-এ বর্তমান জেলা সদরের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় প্রতিদিনই ২৭-২৮ জনকে ধরে নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প নরসিংদীর টেলিফোন এক্সচেঞ্জের টর্চার সেলে আটক রাখা হতো।

নির্যাতন শেষে তাদের নিয়ে যাওয়া হতো বর্তমান ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাঁচদোনা মোড় সংলগ্ন লোহারপুলের নিচে। সেখানে চার-পাঁচজনকে বসিয়ে রেখে তাদের সামনে ২০-২২ জনকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। হত্যা শেষে লোহারপুলের নিচে সবাইকে একসাথে মাটিচাপা দেওয়া হয়।

মুক্তিযোদ্ধারা জানান, নরসিংদী টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবনে হানাদাররা তাদের ক্যাম্প ও  ভবনের পিছনে পশ্চিম ও উত্তর পাশের স্টাফ কোয়াটারের ঘরগুলোতে  টর্চার সেল স্থাপন করে।

আর টেলিফোন এক্সচেঞ্জের এ ক্যাম্প থেকেই জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে অপারেশন চালাত পাকিস্তানিরা। তাছাড়া টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবনে অসংখ্য নিরীহ বাঙালি নারী-পুরুষকে ধরে নিয়ে এসে চালাতো গণধর্ষণ ও  নির্যাতন করা হয়।

পাকিস্তানি বাহিনী নরসিংদী টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবনের যেসব ঘরে বাঙালি নারী-পুরুষদের ধরে নিয়ে ভয়াবহ নির্যাতন চালাত,  সেই ঘরগুলো আজ ধ্বংসের দাড়প্রান্তে। স্বাধীনতার ৫১ বছর পার হলে টর্চার সেলের সেই ঘরগুলোর স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণের আজও নেওয়া হয়নি কোন উদ্যোগ।

 নরসিংদী টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবনের স্টাফ কোয়াটারের ঘরগুলো যেগুলো পাক বাহিনীর অত্যাচার নির্যাতনের নিরব স্বাক্ষী হয়ে আজ নিশ্চিহ্নের পথে সেগুলোকে সংস্কার করা দাবি জেলার মুক্তিযোদ্ধা  ও তাদের পরিবারের সদস্যসহ স্থানীয় বাসিন্দাদের।

স্থানীয় বাসিন্দা বকুল মিয়া বলেন,  এটা পাক বাহিনীর ক্যাম্প ছিল। আমরা কল্পনাও করতে পারিনা এখানে কি হতো।  অনেক সময় তাদের অত্যাচার আর নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে অনেক নিরীহ মারা গেলে তাদেরকে এখানেই মাটিচাপা দিত বা সামনের মেঘনা নদীতে ফেলে দিত। মেঘনা নদীতে এরকম অনেক লাশ ভাসতে দেখেছি।

ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে থাকা পাক বাহিনীর টর্চার সেলের এই ঘরগুলো এখনই সংস্কার করার প্রয়োজন বলে মনে করছে তরুণ সংগঠক সাবেক ছাত্রলীগ নেতা তন্ময় কুমার দাস তনু।

তিনি বলেন আমাদের এই সময় আমরা মুক্তিযুদ্ধ ও আমাদের স্বাধীনতা সম্পর্কে যতটুকু জানতে পারছি আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম ততটুকু জানতে পারবে না। জানার সেই সুযোগও থাকবেনা। তাই পরবর্তী প্রজন্মকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও এর ইতিহাস সম্পর্কে সঠিক ধারনা দিতে নরসিংদী টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবনের টর্চার সেলের ঘরগুলো সংস্কারের কোন বিকল্প নেই।

মুজিব বাহিনীর নরসিংদী অঞ্চলের গ্রুপ কমান্ডার  মনিরুজ্জামান ছট্টু বলেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাক বাহিনী বিভিন্ন স্থান থেকে নিরীহ গ্রামবাসীকে ধরে নিয়ে আসতো। চলাচলের সময় যাদেরকে সন্দেহ হতো তাদের ধরে নিয়ে এসে নির্যাতন চালাত।

এছাড়াও বিভিন্ন স্থান থেকে কিশোরী ও যুবতি মহিলাদের ধরে এনে চালাত গণধর্ষণ। তাদের অত্যাচার নির্যাতন ও গণধর্ষণের ফলে অনেকে মারা গেলে তাদেরকে এখানেই মাটি চাপা দিত বা পিছনের দিকে একটা পুকুর ছিলো সেটাতে ফেলে দেওয়া হতো। আমি মনে করি আরো অনেক আগেই এই ঘরগুলোকে সংস্কারের আওতায় এনে  অনেক আগেই সংরক্ষণ করা উচিত ছিল।

এব‍্যাপারে সেক্টর কমান্ডার ফোরাম ৭১' র নরসিংদী জেলা শাখার সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মোতালেব পাঠান বলেন, 'বিষয়টা ভাবা হয়নি। যেহেতু এখন এ বিষয়ে অবগত হয়েছি তাই নরসিংদীর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আমাদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পাক বাহিনীর টর্চার সেলের এই ঘরগুলোকে সংস্কারের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করবো। আমরা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কাছে ঘরগুলো সংস্কারের জন্য আবেদন করবো।'

নরসিংদীর খবর বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ