
ছোটো বেলা থেকে বাবাকে ভীষণ রাগী বলেই জেনেছি। এখনো উনি ভীষণ রাগী। আমাদের এই রাগী বাবা খুব একটা বদলে যাননি এখনো, কেবল বদলে গেছি আমরা। শৈশব কৈশোর এমনকি যৌবনেও মনে হতো বাবা কেন এমন হবে! আমরা ভাবতাম বাবা হবে আদুরে, বাবার গা ঘেঁষে বসবো আমরা, বাবার সাথে গল্প করবো। কিস্তু আমাদের বাবা এতই রাগী যে আমরা তার সামনে কথা বলতেও সাহস পেতাম না। কড়া নিয়মের মধ্যে আমাদের বড় হতে হয়েছে। সময় মত খাবার খাওয়া, ভোরে ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসা, দুপুরে খাবার পর ভাত ঘুম দেয়া, মাগরিবের আজানের সাথে সাথে ঘরে ঢুকে হাত মুখ ধুয়ে পড়ার টেবিলে হাজির হতে হত।সবকিছু ছিলো রুটিন মাফিক। দুপুরের খাবার সময়টা পর্যন্ত বাঁধা ছিলো। দুপুর দুইটার ভিতর খাবার খেয়ে উঠতে হবে। যদি কখনো খেতে না পারতাম বাবার ভয়ে দুপুরে আর খাওয়া হতো না। আসরের নামাজের পর বাবা বাইরে গেলে তখন খাবার সুযোগ পেতাম। এমনই কড়া অনুশাসনের ভিতর বেড়ে উঠেছি আমরা। সময়ের সাথে সাথে আমাদের এই রাগী বদমেজাজি বাবা যে আমাদের অত্যন্ত প্রিয় পাত্র হয়ে উঠবেন,আট/দশ বছর আগেও ভেবে উঠতে পারি নি।শুধুমাত্র আমাদের স্বচ্ছলতায় রাখার জন্য আমাদের বাবা চাকরি ছেড়ে ব্যবসা শুরু করেন দেশের বাড়ি এসে। এখন আমরা পাঁচ বোন প্রত্যেকেই মা হয়েছি। আমাদের জীবন অনেকটাই সহজ ছিলো কারন আল্লাহ আমাদের এই চমৎকার বাবা মায়ের ঘরে সন্তান হিসেবে পাঠিয়েছেন। বাবার বদৌলতে জীবনে খুব কমই প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছি আমরা।আমাদের সন্তানেরা বড় হচ্ছে আর আমরা বুড়ো হচ্ছি। এখন প্রায়ই স্মৃতির বাক্স মেলে বসি। ঘুরে আসি শৈশব কৈশোর উঠতি যৌবনে, কী কাণ্ড! সমস্ত স্মৃতি আমার রাগী বাবার ভালোবাসায় মণ্ডিত। মা আমাদের সাদাসিদে, রান্না বান্না খাবার পরিবেশনে সীমাবদ্ধ। স্মৃতির ডালা খুললে হুড়মুড় করে বেরিয়ে পড়ে বাবার ভালোবাসা। মনে পড়ে যায় বাবা লিচু, কলা কিনে ঘরের কোনে ঝুলিয়ে রাখতেন। গাছ পাড়ার মত করে আমরা লাফালাফি করতাম সেগুলো নেবার জন্য। কিন্তু কিছুতেই হাতে নাগাল পেতাম না। তখন বাবা শর্ত জুড়ে দিতেন, যে ইংরেজিতে নাম বলতে পারবে তাকে লিচু নামিয়ে দেয়া হবে। বাধ্য হয়ে আমাদের মুখস্থ করতে হতো ইংরেজি নাম। বিছানার তোশকের নিচে থাকতো একটা চকচকা দুই টাকার বাণ্ডিল আর একটা এক টাকার বাণ্ডিল। সকালে বরাদ্দ ছিলো আমাদের দুই বোনের জন্য দুই টাকা করে, বিকালে এক টাকা করে। সেখান থেকে টাকা নিতে কোনো অনুমতির প্রয়োজন ছিলো না। বরাদ্দ অনুযায়ী আমরা নিজেরাই নিয়ে নিতাম। কলোনির ভিতরই ছিলো শিশুপার্ক। বিকেল হলেই দুই বোন সেখানে খেলতে যেতাম। ঢেঁকিতে উঠতে গিয়ে একবার আমার মাথার পিছনে কেটে গেলো। অঝরে রক্ত ঝরছে, সে কি কান্না বড় আপু! কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বাসায় নিয়ে গেলো। আমি হাসছি আর বলছি, বড় আপু কেঁদো না, আমি ঠিক আছি। বাসায় পৌঁছানোর পর আব্বা আমার মাথা চেপে ধরে কাঁদছেন আর দৌড়াচ্ছেন উদ্দেশ্য দ্রুত ডাক্তারের কাছে পৌঁছানো। তখন আমার কান্না পায়নি ঠিকই তবে এখন মনে পড়লে নিজের অজান্তে চোখ ভিজে যায়। এসবই সেই ছোট্ট বেলার কথা তখনো স্কুলে পড়ি না। সরকারি চাকুরীজীবি বাবা আমার ছুটি পেলেই আমাদের দুই বোনকে গায়ে সাবান মেখে ডলে ঘষে যত্ন করে গোসল করিয়ে দিতেন। তারপর গায়ে তেল মেখে জামা পরিয়ে দিতেন। তখন আমরা দুই বোনই ছিলাম। আমাদের রাগী বাবার বাইরের কোনো আড্ডা ছিলো না। তিনি বাইরে এক কাপ চা ও খেতেন না। ছিলোনা চা, পান, সিগারেট বা অন্য কোনো নেশা। সন্ধ্যার পর বাড়ি এসেই বড় আপুকে পড়াতে বসতেন। ঠিকঠাক পড়া পারলে রাতে জিয়া কলোনীর নিরব রাস্তায় বাবার সাইকেলের পিছনে আমাদের ঘুরতে যাবার সৌভাগ্য হতো। খুব স্পেশাল হতো ঈদের আগের দিনগুলো। জামা কেনা থেকে শুরু ঈদের যাবতীয় সাজগোজের জিনিস বাবা কিনে দিতেন আমাদের সাথে করে নিয়ে। এই যেমন এক দোকানে নিয়ে বলতেন, ওদের জামা দেখান। দোকানদার বলতো বাজেট বললে সুবিধা হতো। আব্বা বলতেন, কোনো বাজেট নাই, ওরা যা পছন্দ করবে সেটাই দিবেন। আমরা কখনো জানতাম না সেই জামার দাম কত ছিলো। আমরা কখনো জানতে চেষ্টা করিনি আমাদের এত সৌখিনতায় রাখতে আব্বার কোনো কষ্ট হতো কি না! জামা কেনার পর জুতা কেনা হতো একই রকম ভাবে। এরপর সাজু গুজু, মেকাপ, লিপস্টিক, নেলপলিশ, আইভ্রু, কাজল, হাতের চুড়ি, কানের দুল, ম্যাচিং গলার সেট, সুগন্ধী সবান, স্যাম্পু। কিচ্ছু বাদ যেত না। আজও স্মৃতির পাতায় অমলিন সবুজ রঙের সেই কাচের পুতির মালা। অতসুন্দর মালা আর কোনোদিন দেখার সৌভাগ্য হয়নি আমাদের।
শৈশব কৈশোর মানেই বাবা। এরই মাঝে কেটে গেছে অনেক সময়। আমরা দুই বোন থেকে পাঁচ বোন হয়েছি তবে আমাদের আদর একদমই কমেনি। এত গুলো বোন বলে মানুষের কটাক্ষের শেষ ছিলো না। বিশেষ করে কাছের আত্মীয় স্বজন। তারা বলতেন, এত গুলো মেয়ে তাদের আবার এত আহ্লাদ! তবে আমাদের রাগী বাবা কখনো সেসব পাত্তা দিতেন না। তিনি বলতেন আল্লাহ্ ভালোবেসে আমাকে যা দিয়েছেন আমি খুশি। তিনি তো আমাকে নিঃসন্তান রাখেননি এই জন্য আলহামদুলিল্লাহ। আমাদের রাগী বাবা কখনো হেসে কথা বলতেন না। এটা নিয়ে আমাদের সবার ভীষণ অভিযোগ ছিলো। তবে এখন নেই।আমাদের রাগী বাবা এখন হেসে কথা বলেন। সবচেয়ে অবাক হই যখন আমাদের বাচ্চারা উনার কাঁধে চড়েন, উনার চুল টানেন দাঁড়ি টানেন আর উনি হো হো করে হাসেন। আমরা এখন বুঝতে শিখেছি আমরা জীবনে যে যেখানে যতটুকু ভালো আছি, যতটুকু প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছি সব এই রাগী বাবার বদৌলতে। আমাদের বাবা নিজের জীবনের পনেরোটা বছর দুটো শার্ট প্যান্ট পরে কাটিয়েছেন। অথচ আমাদের দিয়েছেন সৌখিন জীবন। এটা শুধুমাত্র বাবারাই পারেন।
বড় আপুর তখন বিয়ে হয়ে গেছে, বড় আপু স্কুলে চাকুরি করেন। ভীষণ বৃষ্টি, পথ ঘাট তলিয়ে গেছে। বড় আপু বাসায় ফিরলো জুতা ভর্তি কাঁদা নিয়ে। আমাদের রাগী বাবা চোখের পলকে জুতো জোড়ার কাঁদা ছাড়িয়ে পরিস্কার করে ধুয়ে পানি ঝরাতে দিলেন। ভিতরে এসে বললেন তোর জুতাতো নষ্ট হয়ে গেছে আরেক জোড়া কেনা দরকার। আমাদের চোখে পানি এলো।ছোটো বেলায় উনি বকতেন বলে আমরা উনাকে ভুল বুঝতাম সে অপরাধবোধ আমাদের কুঁড়ে খায়। উনি কঠিন হাতে আমাদের শাসন করেছেন ঠিকই তার চেয়ে ভালোবেসেছেন বেশি । পাছে উনার ভালোবাসা বুঝতে পেরে আমরা উচ্ছ্বনে যাই তাই আমাদের রাগী বাবা তার ভালোবাসা প্রকাশ করতে কার্পন্য করতেন। ছোটো বেলায় শুধু শাসনটাই দেখতে পেতাম। সময় বদলেছে, আমরা বদলেছি এখন দেখতে পাই কেবল ভালোবাসাটা। স্মৃতির পাতা উল্টালে কী বকা! কী ভালোবাসা! আমাদের জীবনটা ছিলো বাবাময়।