নূরুদ্দীন দরজী
দুলাভাই,ও দুলাভাই! একটু দাঁড়াইন ! জরুরী কথা আছে। এ ডাক আমাদের ছনুর। তখন হয়তো আমি ব্যাগ নিয়ে বাজারে যাচ্ছি। অথবা মসজিদে নামাজ পড়ার পর বাড়ি ফিরছি। নতুবা বৈকালিক হাঁটাহাঁটিতে বের হয়েছি। ছনুর "একটু দাঁড়াইন, কথার সাড়া দিয়ে ফিরে দেখি সে অনেকটুকু দূরে। সব সময় না পারলে ও অনেক সময়ই দাঁড়াই। ছনুর আসতে অনেক কষ্ট হয়। কাছে এসে যা বলে তা নিতান্তই শ্যালক ও দুলাভাইদের কথা। ছনু প্রায়ই বলে," আমার এ অসুবিধা, সে সমস্যা, হাটতে পারি না।
কদিন যাবৎ বিছানায় পড়ে আছি-ঔষধ কিনতে হবে, টাকা লাগবে, কিছু টাকা দেন। উত্তরে অনেক সময় বলি" ছনুরে, আমিতো এখন আর চাকরি করি না, অবসর মানুষ, এখনতো আমার হাতে আগের মত টাকা পয়সা থাকেনা,। আর ও বলি, আমিত শুনেছি তুই ১৪২টি বিয়ের ওকালতি করেছিস,। মুরগীর ব্যবসায় ও মন্দ করিসনি- তোর ঐ টাকা পয়সা গেলো কোথায়? কানে হাত দিয়ে ছনুর উত্তর- কি কইলেন? একই কথা কয়েকবার বলি। অরিন্দম নাহি কহে কিছু! কিছুই বুঝতে পারে না। কানে একেবারেই কম শোনার কারণে হয়তো বা বিরক্ত হয়েই বলে," আপনেরে আল্লায় দিবে। আল্লায় আপনেরে অনেক দিয়েছে।
আমি মনে মনে আল্লাহ আমাকে যা দিয়েছেন তাই নিয়ে হিসেব করি। মেনে নেই,যা পেয়েছি মহান রাব্বুল আলামীনের দরবারে শুকরিয়া জানাই। সব সময় না পারলেও মাঝে মধ্যে ছনুর হাতে যতটুক সম্ভব টাকা পয়সা দিতে চেষ্টা করি। আর এটা দেই বেশির ভাগ দুলাভাই,দুলাভাই বলে ডাকার আকুতিতেই, অন্য কিছুই নয়। শুধুই আমি নই, আমাদের গ্ৰামের অনেকেই তাকে যতটুকু সম্ভব টাকা পয়সা দেয়। অনেক সময়ই না দিলে সে রাগ করে। হয়তো গ্ৰামের মানুষের প্রতি এটি তার অধিকার মনে করেই রাগ করে। আর রাগ করবেই না কেন। শারীরিক কষ্ট তাকে সর্বদাই মেজাজী করে রাখে। এমন যার হয়েছে সে বিনে অন্য কেউ সে কষ্টের কথা বুঝিবে না।
প্রায়ই মনে প্রশ্ন জাগে- ছনু আমাকে দুলাভাই বলে কেন! দুলাভাইতো ডাকা হয় শ্বশুর বাড়ির সম্পর্কে। স্ত্রীর ছোট ভাই ও বোন সম্পকের্র মানুষেরাইতো দুলাভাই ডাকে। কোন এক অবসরে একদিন আমার স্ত্রী সামসুন্নাহার খানকে জিজ্ঞেস করে বসি; ছনু তোমার কি লাগে, ছনু আমায় দুলাভাই ডাকে কেন ? হাসতে হাসতে সামসুন্নাহার খান বলেন,*অপেক্ষা করো,হিসেব করে উত্তর দিতে হবে,। কিছুক্ষণ চিন্তা করে পুনরায় বলেন," আমার চাচাতো দাদীর বোন ছনুর দাদী হতো, সে হিসেবেই সে তোমায় দুলাভাই বলে হয়তো,। আনন্দে আমি বলি, তুমিতো কাছাকাছি সম্পকের্র কথাই বলছো,। বন্কিম চন্দ্র তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস" বিষবৃক্ষ" এর চরিত্র মাঝি "রহমত, এর পরিচয় দিয়ে বলেছেন,রহমতের নানার খালার বাবা ও নাকি মাঝি ছিল,।
সে তুলনায় ছনুতো আমাদের অনেক কাছেরই। আর যাই হোক, ছনু আমাকে সদা সর্বদা যেভাবে দুলাভাই ডাকে আমি তার দুলাভাইই হয়েই রইলাম । আমি ছনুকে তুই বলে সম্বোধন করি। অনেকেই জানেন যে, অতি কাছের বন্ধু এবং ছোট শ্যালক শ্যালিকাকে মানুষ তুই বলেই বেশি সম্বোধন করেন। এর কেন জানি একটি আলাদা উদারতার মজা রয়েছে। ছনু ও ঠিক তেমনটি আমার কাছে।
সুহৃদ পাঠক মহোদয়গণকে বিনীতভাবে জানাতে চাই যে, ছনু আমাদের গ্ৰামের একটি সুপরিচিত সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষ। তার পূর্ণ নাম মোঃ ছানাউল্লাহ খান। পিতা মরহুম মোঃ নন্দু খান। ছনুরা ছয় ভাই ও তিন বোন। পাড়ার অন্যান্য ছেলেমেয়ের মত ছনুর ও কেটে যাচ্ছিল হাস্যোজ্জল চটপটে জীবন। ছনু ও ছিল পরিবারের আদরে ছেলে। বেড়ে উঠছিল উদীয়মান যুবক হয়ে। তার পরিচিতি ছিল সর্বত্র। গ্ৰামের খোলা প্রান্তরে হেসেখেলে চলছিল কৈশোর ও নবাগত যৌবনকাল।
ছনু ঘর সংসার ও করেছে। সে খুবই সাহসী যা এখনো তার মধ্যে দেখা যায়। ছিল খুবই ফুটবল খেলা প্রিয় মানুষ । কোন এক দিন নিজ গ্ৰাম থেকে ৭/৮ মাইল দূরের পাশ্ববর্তী চক্রধা ইউনিয়নের একটি খেলার মাঠে খেলা দেখতে গিয়েছিল। সেটিই হয়ে যায় তার জন্য কাল। জীবনের মধুর খেলা হয়ে যায় শেষ। খেলা শেষে বাড়ি ফেরার পথে খানিকটা অসতর্কতা বশতঃ রাস্তা থেকে ছিটকে পাশের বড় একটি গর্তে পড়ে যায়। তখন ছিল শীতকাল।
ছনু কোনক্রমেই গভীর কাদা ভেদ করে উঠতে পারছিল না। ঘটনার অনেক পরে রাস্তার অন্যান্য ২/১ জন পথিক তাকে গর্ত থেকে উঠিয়ে পা ভাঙা অবস্থায় দয়া করে বাড়িতে পৌছে দিয়েছিল। আর সে থেকেই ছনু অসুস্থ্। অনেক চিকিৎসা করে ও আজ পর্যন্ত রোগ মুক্ত ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি। এক সময়ের টগবগে ছেলেটি বলতে গেলে আজ ও পংগু হয়ে আছে।
তবে ছনুর মনের জোর প্রবল। চেষ্টা করে নিজে নিজে চলতে। নেহায়েত কাছের মানুষ ছাড়া কাউকে নিজের কষ্টের কথা বলে না। আত্মীয় স্বজনের কাছে যেতে চেষ্টা করে। ক্রমাগত দুর্বল হতে হতে ও বয়স বৃদ্ধির কারণে এখন তার হাটতে খুবই সমস্যা হয়। কিছুতে না ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনা। পরনের জামা কাপড় ঠিক রাখা মুস্কিল হয়ে যায়। দিনের আলো থাকতে থাকতেই বাড়ি ফিরে প্রতি দিন। হাটার কষ্ট দেখলে চোখে পানি এসে যায়। গ্ৰামের মসজিদে অনেক কষ্টে পা দুটো সোজা করে বসে নামাজ আদায় করে। মহান আল্লাহর সমীপে মন হয়তো বলে- জীবনের করুণ কাহিনী। কবে কখন ছনু করুণাময়ের দয়া পাবে একমাত্র বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের মালিকই জানেন।
তার এহেন দূরাবস্থায় ও হাত পেতে অন্যের সাহায্য সহযোগিতা নেয় না। সব সময়ই চেষ্টা করে নিজে পরিশ্রম করে চলতে। যাকে একান্তই আপন মনে করে তাঁর কাছে দুঃখের কথাগুলো বলে। আমি ছনুকে একবার বলেছিলাম," ছনুরে ! মানুষের কাছে তোর জন্য সাহায্যের কথা বলি? ছনুর প্রতিক্রিয়া! উত্তর!- ভিক্ষার কথা কইন? এগুলাইন কইরা বাড়ির ও গ্ৰামের ইজ্জত দিমু না,। ছনুর এ উত্তরে আমার মন ভরে যায়। মনের গভীরের সুখানুভুতি বলে উঠে, ছনুরে,- এ জন্যইতো বলি,আমাদের দত্তেরগাঁও ঐতিহ্যবাহী,। লেখাটি শেষ করার আগে তার জন্য সবার প্রতি দোয়ার আবেদন জানাচ্ছি।
লেখক : সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার (টিইও)