প্রতিদিন ভোর হয় নতুন আশা নিয়ে, কিন্তু প্ল্যাটফর্মের মানুষগুলোর কাছে ভোর মানে ব্যস্ততা আর রুজির সন্ধান। ঢাকা শহরের এই বড় স্টেশনে, প্রায় দশ বছর ধরে করিম আর তার স্ত্রী রহিমার সংসার। তাদের জীবন যেন ট্রেনের হুইসেলের মতোই ক্ষণস্থায়ী আর ছুটে চলা।
করিম স্টেশন থেকে যাত্রীদের মালপত্র টেনে এক প্ল্যাটফর্ম থেকে অন্য প্ল্যাটফর্মে নিয়ে যায়। তার কাঁধের বোঝাটা শুধু মালের নয়, অনিশ্চিত ভবিষ্যতেরও। রহিমা প্ল্যাটফর্মের এক কোণে ছোট্ট একটা চায়ের দোকান চালায়—আসলে চা-পাতা, চিনি আর গরম জলের একটা কৌটা। দুটো ভাঙা মাটির ভাঁড়ে সে চা বানায়। "এক কাপ গরম চা, দাদা? ঘুম ছুটে যাবে!" তার হাসিতে ক্লান্তি লেগে থাকে।
দিনের বেলায় যাত্রীদের ভিড়ে তাদের দুঃখ চাপা পড়ে যায়। কিন্তু রাত নামলে, যখন শেষ ট্রেনটিও চলে যায়, প্ল্যাটফর্ম শান্ত হয়, তখন তাদের জীবনযাত্রা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্ল্যাটফর্মের নিচে, একটি জীর্ণ চাদর ও ছেঁড়া কম্বল পেতে তাদের রাত কাটে। আকাশে লাখ লাখ তারার নিচে, তাদের মাথার ওপরের ছাদটি আসলে ট্রেনের যাত্রীদের অপেক্ষার স্থান।
একদিন গভীর রাতে করিমের হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। ট্রেনের শব্দের বদলে তার কানে আসে বৃদ্ধ রতন-এর দীর্ঘশ্বাস। প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চে বসে থাকা রতন, যার দিন কাটে শুধু ট্রেনের দিকে তাকিয়ে, যেন কোনো এক হারানো যাত্রীকে খুঁজছে।
করিম জিজ্ঞেস করে, "কী হয়েছে, রতন কাকা? এত রাতে জেগে আছেন কেন?"
রতন কাকা নরম গলায় বলেন, "আর বলিস না, করিম। আজ আমার ছেলের ফেরার কথা ছিল। বিশ বছর আগে এই স্টেশন থেকেই সে চলে গিয়েছিল, বলেছিল ফিরবে। এই প্ল্যাটফর্মই আমার ঘর, আমার পৃথিবী। সে হয়তো কোনো এক ট্রেনে আসছে..." রতন কাকার চোখ দুটো চিকচিক করে ওঠে।
করিম বোঝে, স্টেশনে বসবাসকারী এই মানুষগুলোর একেকজনের গল্প কত করুণ। তারা শুধু প্ল্যাটফর্মের বাসিন্দা নয়, তারা সবাই যেন এক একটি স্থায়ী অপেক্ষার যাত্রী। কেউ অপেক্ষায় থাকে হারানো সন্তানের, কেউ বা অপেক্ষায় থাকে একটি ভালো কাজের, আর কেউ অপেক্ষায় থাকে সমাজের একটুখানি সম্মানের।
পরের দিন সকালে, রহিমা তার চায়ের কাপে একটু দুধ বেশি দিয়ে রতন কাকাকে চা পরিবেশন করে। সামান্য দুধ আর চিনির মিষ্টিতে রতন কাকার মুখে হাসি ফোটে। করিম আর রহিমা জানে, তাদের কাছে হয়তো কোনো পাকা বাড়ি নেই, কিন্তু এই প্ল্যাটফর্মের মানুষগুলোই তাদের আসল পরিবার। তারা একে অপরের দুঃখ-সুখে অংশ নেয়, এটাই তাদের বেঁচে থাকার শক্তি।
একদিন এক তরুণ সমাজকর্মী স্টেশনে এসে করিম ও রহিমার সঙ্গে কথা বলে। তাদের জীবন সংগ্রামের কথা শুনে সে খুব অনুপ্রাণিত হয়। সে একটি এনজিও-র মাধ্যমে তাদের জন্য ছোট একটি থাকার জায়গা ও একটি স্থায়ী দোকান তৈরি করে দিতে সাহায্য করে।
যাওয়ার আগে সমাজকর্মী রতন কাকাকে জিজ্ঞাসা করে, "আপনার জন্য কী করতে পারি, কাকা?"
বৃদ্ধ রতন কাকা সেই দিনের মতো হাসেন। প্ল্যাটফর্মের দিকে ইশারা করে বলেন, "আমি এখানেই ভালো আছি, বাবা। আমার ছেলে একদিন ফিরবেই, এই স্টেশনেই। তোমরা শুধু এই মানুষদের ভুলে যেও না।"
করিম আর রহিমা তাদের নতুন দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দেখে, সকালের প্রথম ট্রেনটা স্টেশনে ঢুকছে। প্ল্যাটফর্মের মানুষগুলোর মুখে ক্লান্তি থাকলেও, তাদের চোখে এখন নতুন দিনের আলো, নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন। তারা জানে, জীবন নামক এই ট্রেনটা ছুটে চললেও, একে অপরের হাত ধরে তারা ঠিক গন্তব্যে পৌঁছাবে। প্ল্যাটফর্মের নিচে থেকেও, তারা এক টুকরো আকাশের স্বপ্ন দেখে, যেখানে সম্মান আর ভালোবাসা আছে।