নুরুল ইসলাম নূরচান: ফকির কদমালী মোবাইলে সেভ করা ফোন নম্বরটি বের করলেন। তারপর কাঙ্খিত ব্যক্তির কাছে ফোন করলেন, 'হ্যালো স্যার!'
-'জ্বি বলো?'
-আমি কাল সকল দশটার সময় আসবো স্যার, আপনি বাড়িতে থাকবেন কিন্তু!'
'-ঠিক আছে। '
সে প্রতি মাসের নির্ধারিত একটা সময় ফোন করে করে তাদের বাড়িতে গিয়ে হাজির হন এবং টাকা পয়সা নিয়ে আসেন।
যে কথা সে কাজ। সকাল দশটা বাজে সেই বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলেন ফকির কদমালী।
বাড়িওয়ালাকে গিয়ে সালাম দিল সে। বাড়িওয়ালা সালামের জবাব দিল। বলল, 'তুমি তো একমাস পরে এসেছ, তো কি খাবে বলো?'
'-স্যার আমি সকালে তেমন কিছু খাই না, শুধু একটা ডিম আর দুটি পরোটা।'
'-বলো কি, প্রতিদিন একটা ডিম খাও!'
'-জ্বি স্যার, না হলে স্বাস্থ্য ঠিক থাকে না।'
'-ভালো, খুব ভালো। তোমার মত যদি সবাই সচেতন হতো তাহলে কারো অসুখ বিসুখ থাকত না'- বলে একটু নড়চড়ে বসলেন আইয়ুব খান। একটু পর দুজনের জন্য নাস্তা চলে এসেছে।
ফকির কদমালী আবার বলতে লাগলেন, 'কী করবো স্যার, প্রতিদিন শরীরের উপর দিয়ে অনেক ধকল যায়, গাড়িঘোড়া বা রিকশা করে প্রতিদিন তিরিশটি বাড়িতে যেতে হয়। সরাসরি উপস্থিত না হলে তো আর কেউ টাকা দিতে চায় না!'
'-তা ঠিক, তবে এখন তো বিকাশ বা নগদ এর মাধ্যমে টাকা লেনদেন করা যায়।'
'-আপনি ঠিকই বলেছেন স্যার, এই বিষয়টি নিয়ে আমার সমিতির লোকজনের সাথে বসে কথা বলব। যদি স্বেচ্ছায় কেউ দিতে না চায় তাহলে আন্দোলনে নামবো!'
'-ও, তুমি তো আবার ভিক্ষুক সমিতির সভাপতি, তাই না?'
'-জ্বি স্যার।'
'-কিন্তু দেশ তো এখন অনেক উন্নত হয়েছে, তাহলে ভিক্ষা করো কেন?'
'- এখন ভিক্ষা তো করি না, দেশ উন্নত হওয়ার পর থেকে সাহায্য তুলি। এখন কারো কাছে ভিক্ষা চাইতে লজ্জা লাগে!'
'-তোমার ছেলে মেয়ে ক'জন?'
'-দু' ছেলে এক মেয়ে, স্যার।
'-তাদের বিয়ে-শাদী করিয়েছো?'
'-জ্বি, স্যার। ছেলেরা আলাদা সংসার করে। আপনাদের মত দয়ালু লোকজনের কাছ থেকে যে অর্থ পাই তা দিয়ে আমরা বুড়োবুড়ি চলি।'
'-তুমি এ পেশায় আছো কতদিন যাবত?'
'-বছর পাঁচেক হবে স্যার। আগে একটি পাটকলে চাকরি করতাম, পরে লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে কর্তৃপক্ষ পাটকলটি বন্ধ করে দেয়। শরীরও খুব দুর্বল হয়ে পড়ে, তাই বাধ্য হয়ে অবশেষে এ পথ ধরেছি।'
'-আচ্ছা কদমালী আমাকে 'স্যার' ডাকার জন্য কেন বলেছি জানো?'
'-নাহ, জানি না স্যার।'
'-একমাত্র শিক্ষককে ছাড়া আর কাউকে স্যার ডাকা ঠিক না, কাউকে 'স্যার' সম্বোধন করলে তার মধ্যে একটা আত্মঅহংকার চলে আসে, যেমন আমাকে কেউ স্যার বললে আমার খুব ভালো লাগে, নিজের কাছে নিজেকে অনেক বড় মনে হয়!'
'-স্যার আপনার এই মূল্যবান কথা শুনতে খুবই ভালো লাগে, এই জন্যই আপনার কাছে আসলে আর যেতে মন চায় না। আচ্ছা স্যার আপনি এত বড় একজন কর্মকর্তা ছিলেন, অথচ প্রায় সময় দেখি চায়ের দোকানে আড্ডা মারেন, আপনার মতো কর্মকর্তা তো চায়ের দোকানের ধারে কাছেও যেতে চায় না, তাহলে আপনি যান কেন!'
'-চায়ের দোকানে আড্ডা মারলে তো আর ইজ্জত যায় না, বরং ইজ্জত বাড়ে, অনেকেই বলে, 'স্যার এসেছে। চেয়ার দাও।' এতে করে আমার একাকীত্ব দূর হয় এবং মনে প্রশান্তি আসে, আমি যদি সারাক্ষণ ঘরে বসে থাকি তাহলে মানুষজন কী আমার সাততলা বাড়িতে এসে আমাকে সম্মান করবে! বাইরে বের হলে তো অনেকেই বলে, ওই যে স্যার এসেছে! তাই মাঝেমধ্যে চায়ের দোকানের পাশে বসে আড্ডা মারি। তাছাড়া অনেকেই সুখ দুঃখের কথা আমার সাথে শেয়ার করে। আমি মানুষের ভালো-মন্দ খবর নিতে পারি।'
'-এখন বিষয়টা বুঝতে পেরেছি স্যার। আসলে আপনার কোন জুরি নেই।'
ফকির কদমালী বললেন, 'স্যার আপনারা তো অনেকগুলো ধনী আছেন এই এলাকায়, আমরা তো সামান্য কয়েকজন গরীব বা ফকির। তো আপনারা ইচ্ছা করলে তো আমাদেরকে ধনী বানিয়ে দিতে পারবেন!'
'হুঁ, পারি।
'-তবে সেই কাজটা আপনারা করেন না কেন স্যার?'
'-আরে বোকা তোমাদেরকে যদি আমরা বড়লোক বানিয়ে ফেলি, তাহলে আমাদের ধনীদের মূল্য থাকলো কার কাছে! কেউ কি কোনদিন আমাদের কাছে সাহায্যের জন্য আসবে, কেউ কি কোনদিন এসে বলবে, স্যার আমাকে একটু সাহায্য করেন! আমাদেরকে স্যার ডাকার মত লোকের অভাব পড়বে তখন। শোন, এই কথাটা নিতান্তই তোমাকে আপন মনে করে বলেছি, তুমি আবার অন্যদের কাছে কথাগুলো বলে দিও না।'
'-না স্যার, এই কথা কস্মিনকালেও কাউকে বলবো না।'
'-কদমালী তোমার তো টুপি-দাড়ি আছে; নামাজকালাম ঠিকমতো করো?' বলে আইয়ুব খান এক খিলি পান মুখে ঢুকালেন।
'-সত্যি কথা কি জানেন স্যার, ঠিক মত নামাজ পড়ি না, টুপি- দাড়ি না থাকলে অনেকেই সাহায্য সহযোগিতা করতে চায় না। তাই এই বেশ ধরেছি।' ফকির কদমালী মাথার শেরওয়ানি টুপিটা চাপ দিয়ে ঠিকমতো বসালেন।
আইয়ুব খান গম্ভীর গলায় বললেন, 'মানুষকে কখনো ধোঁকা দেওয়া ঠিক না কদমালী।'
'-জ্বি, স্যার।